
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিনকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করা না হলে দক্ষিণাঞ্চল অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক–কর্মকর্তা–কর্মচারীদের একাংশের সংহতি সমাবেশে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা সমাবেশ শেষে বেলা দেড়টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল করেন তাঁরা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রশাসনিক অদক্ষতা, কর্তৃত্ববাদী মনোভাব, একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাচারিতার কারণে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমেছে তাঁদের।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, আগামীকাল মঙ্গলবার বেলা দুইটার মধ্যে দাবি মানা না হলে দক্ষিণবঙ্গকে বাংলাদেশের বাকি অংশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। আমরা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে চাই না, চাই শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক সমাধান।’
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ভূমিকা সরকার বলেন, ‘আমরা আগেও ২২ দফা, ৪ দফা দাবি জানিয়েছি। আজকের সমাবেশ ছিল উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একসঙ্গে নিয়ে একটি সংহতি কর্মসূচি। উপাচার্যের প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা ও দায়িত্বহীনতার প্রেক্ষাপটে আমাদের দাবি এখন একটাই তাঁর অপসারণ।’
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীন, লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সিরাজিস সাদিক, বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উন্মেষ রায়, মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফেরদৌসী জামান, সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. সাদিকুর রহমান ও অসিম কুমার নন্দী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ টি এম রফিকুল ইসলাম, সিএসই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাহাত হোসেন (ফয়সাল), গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শফিউল আলম প্রমুখ।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের অপসারণ ও ‘পাতানো’ সিন্ডিকেট সভা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তাঁর বাসভবনের ফটক ভাঙচুর করে বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এরপর গত ১৩ এপ্রিল উপাচার্যের নির্দেশে তৎকালীন রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক নোটিশে অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাঁকে সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ এপ্রিল অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীনকে পুনর্বহাল, রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অপসারণসহ চার দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা রেজিস্ট্রারকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ দাবি করে কুশপুত্তলিকা দাহ করেন এবং রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে তালা দেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) কে এম সানোয়ার পারভেজ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ মে ঢাকায় সিন্ডিকেট সভায় মনিরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। পর দিন ৪ মে উপাচার্য শুচিতা শরমিন সংবাদ সম্মেলন করে ওই সিদ্ধান্তের কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা মুচলেকা দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলা ও জিডি প্রত্যাহারের আশ্বাস দেন উপাচার্য। সেই সঙ্গে অধ্যাপক মুহসিন উদ্দীন তাঁর সিন্ডিকেট সদস্য পদে পুনর্বহালের বিয়ষটি নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় এ বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার হবে বলে জানান উপাচার্য। এ ছাড়া সিন্ডিকেট সভায়, ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থক শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নিতে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে অবহিত করেন উপাচার্য। এরপর ওই দিন দুপুরে আন্দালনরত শিক্ষার্থীদের ওই অংশ পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবির আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তাঁরা প্রশাসনিক ভবন ও উপাচার্যের বাসভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।
চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে উপাচার্য শুচিতা শরমিন দাবি করেছেন যে আন্দোলনটি কতিপয় ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিচালনা করছেন। শিক্ষার্থীদের তিনি বারবার অনুরোধ করেছেন যেন তাঁরা ভুল পথে না যান এবং আন্দোলন থেকে ফিরে আসেন।
কিছু ব্যক্তি তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত ও ব্যবহার করছেন উল্লেখ করে শুচিতা শরমিন বলেন, ‘আমরা যারা এখন উপাচার্যের দায়িত্বে রয়েছি, তারা এই সরকারের ভাবনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি। ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমি একমাত্র নারী উপাচার্য এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যেমন নারীর উন্নয়নে অবদান রেখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তেমনি সেই চেতনা থেকেই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য।’
উপাচার্য জানান, অতীতেও এমন আন্দোলন হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু এবারের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের যেসব দাবি ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে। এখন যখন আর কোনো দীর্ঘমেয়াদি দাবি নেই, তখন এক দফা দাবি সামনে রেখে আন্দোলন চালানো হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য বলেন, তাঁরা (শিক্ষার্থীরা) যেন সচেতন হন এবং বুঝতে শেখেন যে কে তাঁদের প্রকৃত উপকার চিন্তক আর কে ব্যক্তিস্বার্থে তাঁদের ব্যবহার করছেন। অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এই আন্দোলনের পক্ষে নন এবং যাঁরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষা ও উন্নয়ন চান, তাঁরা জানেন যে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে দেওয়ার মাধ্যমে কারও মঙ্গল হবে না।
শুচিতা শরমিন আশা প্রকাশ করে বলেন, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আবারও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠবে।